জাতীয় সংসদে দ্বিতীয়বারের মতো বক্তব্য দেওয়া সুযোগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা। গতকাল রোববার সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসেবে সম্পূরক বাজেটের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কথা স্মরণ করলে সরকারদলীয় সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এ সময় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বিনয়ের সঙ্গে তাকে মূল বক্তব্যের বাইরে কথা বলতে মানা করেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ হিসেবে বক্তব্য দেওয়া কথা উল্লেখ করে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী রুমিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মাননীয় সদস্য আমি আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব, আপনি এমন কোনো কথা বলবেন না যেটাতে অপর পক্ষ উত্তেজিত হবে এবং সংসদ পরিচালনায় ব্যত্যয় ঘটবে। আমি চাই এই সংসদটা প্রাণবন্ত হোক।’
এ সময় সরকারদলীয় সদস্যরা আরও উত্তেজিত হয়ে হই হই করতে থাকেন। রুমিন ফারহানা বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার আমি আমার দলের কথা বলব, তারা তাদের কথা বলবেন। কিন্তু আমি উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো সংসদ যদি উত্তেজিত হয়ে যায়, ৩০০ সদস্য যদি মারমুখী হয়ে যান তাহলে আমি আমার বক্তব্য কীভাবে রাখব?’
ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া এ সময় আবারও তাকে তার নির্ধারিত বিষয়ের উপর বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘মাননীয় সদস্য; আপনি কিন্তু সাপ্লিমেন্টারি বাজেটের উপর বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েছেন। দয়া করে আপনি আপনার নির্ধারিত বিষয়ের উপর কথা বলুন। সংসদীয় নিয়ম রক্ষা করুন। আপনি সাপ্লিমেন্টারি বাজেটের বাইরে দয়া করে কথা বলবেন না।’
তারপরও রুমিন ফারহানা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও কারাবন্দী দলের চেয়ারপরসন খালেদা জিয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। পরে সম্পূরক বাজেটের উপর আলোচনায় তিনি বলেন, ‘একটা সরকারের সক্ষমতা ক্রমশ বাড়ার কথা। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি এ সরকারের সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বাজেটের মাত্র ৭৬ শতাংশ আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। যে রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সেই রাজস্ব আমরা কখনই আদায় করতে পারি না।’ এ সময় এডিপির সমালোচনাও করেন তিনি।
বাজেটে নির্বাচনের কথা এসেছে উল্লেখ করে রুমিন বলেন, ‘এ নির্বাচন কমিশন কী ধরনের নির্বাচন করেছে- স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। কী ধরনের নির্বাচন হয়েছে, এখানে যে সদস্যরা রয়েছেন তারা আল্লাহকে হাজির নাজির করে বলুক সংবিধান অনুযায়ী জনগণের প্রত্যেক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন কি না।’ এ বিষয়টি নিয়েও সমালোচনা করেন তিনি।
রুমিন ফারহানা আরও বলেন, ‘তারা কয়জন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুক। যদি বিবেক থেকে থাকে আপনাদের নিজেদের উত্তর নিজেই পেয়ে যাবেন। কী ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে এ সংসদে এসেছেন। আমাদের কথা দেওয়া হয়েছিল, এ সংসদে আমাদের কথা বলতে দেওয়া হবে। এ জন্য এ সংসদ নির্বাচিত নয় জেনেও আমরা সংসদে যোগ দিয়েছি। কারণ, আমাদের মিটিং করতে দেওয়া হয় না। ভেবেছিলাম সংসদে জনগণ, আমার দল নিয়ে কথা বলতে পারব। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এ সংসদের সরকারি দলের এমপিদের এতটুকু ধৈর্য নেই আমার কথা শোনার।’
এ সময় ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া আবারও তাকে নিজের নির্ধারিত বিষয়ের উপর কথা বলতে অনুরোধ করেন। বলেন, ‘আপনি দয়া করে এমন কোনো কথা বলবেন না, যেটা আমাকে এক্সপাঞ্জ করতে হয়। আমি এক্সপাঞ্জ করতে চাই না। রুমিন ফারহানা এ সময় ডেপুটি স্পিকারকে তার এখতিয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ডেপুটি স্পিকার নিজেও। তিনি বলেন, ‘তাহলে আপনি বসেন। প্লিজ সিট ডাউন। ’
তখনও সরকারদলীয় সদস্যরা হই হই করছিলেন। এ সময় বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের এই সদস্য বলেন, ‘দেশে আইন আছে, আদালত আছে। কিন্তু আইনের শাসন নেই। সে কারণে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে গত এক বছরে বিচারবর্হিভূত ৪৫০টি হত্যা হয়েছে। এ বিচারবর্হিভূত হত্যা কত জঘন্য ঘটনা, কোনো সভ্য রাষ্ট্রে তা চলতে পারে না। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট মতে, গত এক দশকে গুম হয়েছে ৬শর উপরে। আমার সুযোগ হয়, এ গুম হওয়া পরিবারের সঙ্গে বসার। তারা এখন শুধু লাশ চায়, যাতে একটু কবর দিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, গত এক মাসে মৃত্যু উপত্যকা বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৬৮টি। বাংলাদেশ এখন ধর্ষণের রঙ্গমঞ্চ। আমার দুঃখ লাগে স্পিকার এ সংসদের একজন নারী এমপিও এ নিয়ে কথা বলেন না। বাংলাদেশে এখন এক বছর থেকে শুরু করে ১০০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু কোনো বিচার হয় না। কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত বা সুবিধাভোগী তারাই এ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা সম্পর্কে বিএনপির এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘এ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম তৈরি হয়। এ টাকায় কানাডায় বেগম পাড়া তৈরি হয়। পানামা পেপারে নাম আসে কিন্তু বিচার হয় না। এ দেশে গরিবের সোনা তামা হয়ে যায়। পাথর চুরি হয় যায় কিন্তু বিচার হয় না।’
সংসদে ধর্ষণের তথ্য উপাত্তও তুলে ধরেন তিনি। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইনের সমালোচনাসহ মন্দ ঋণের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান তিনি। জাতীয় বাজেটের টাকা হিসাব চেয়ে তালিকা প্রকাশ করারও দাবি করেন রুমিন ফারহানা।
বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি বলেন, একটু জবাবদিহিতাহীন সরকার যদি থাকতো, একটু বিরোধী দলের কথা শোনার ধৈর্য্য যদি থাকতো তাহলে আজকে বাংলাদেশের এই অবস্থা হয় না। আমি আবারও আমার বক্তব্যে মনে করিয়ে দিচ্ছি, প্রত্যেকে যদি যার যার বিবেককে আপনারা কী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, কেউ হন নাই। এ সময় তার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। সময় শেষ হওয়ায় তিনিও খালি গলায় তার বক্তব্য শেষ করেন।
পরে পরে ডেপুটি স্পিকার তাকে উদ্দেশ্যে বলেন আপনি বাজেটের বাইরে ও সংসদীয় ভাষার বাইরে যে কথাগুলো বলেছেন তার সবকথা সংসদীয় প্রসিডিউর থেকে এক্সপাঞ্জ করা হলো।